বাংলাদেশ ‘অরক্ষিত’। বাংলাদেশ সব দিক থেকেই শত্রু পরিবেষ্টিত। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ কিভাবে টিকে রয়েছে সেটাই বিস্ময়ের। ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে, পরাশক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ তীব্র হচ্ছে, মেরুকরণ ঘটছে; এরই মধ্যে জায়নিস্ট কলোনিয়াল রাষ্ট্র ইজরায়েল গাজায় অবিরাম বোমা নিক্ষেপ ও নির্বিকার গণহত্যা চালিয়ে বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বাস্তবতায় নিজেদের রক্ষা করবার কর্তব্য আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক আলোচনার প্রধান বিষয় হবার কথা বাংলাদেশের বুদ্ধিবুত্তিক ও রাজনৈতিক চিন্তায় সম্পূর্ণ এবসেন্ট! থতমত খেতে হয়।
ফরহাদ মজহারের ‘গণপ্রতিরক্ষা’ বইটি বেরোয় আজ থেকে ১৮ বছর আগে, ২০০৬ সালে, যখন প্রতিরক্ষা নিয়ে সমাজে কিছুটা হলেও তর্কবিতর্ক ছিল। ভূরাজনীতি এবং বৈশ্বিক বাস্তবতার পতিপ্রেক্ষিতে বইটি প্রকাশের পরপরই দারুন জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং অল্প সময়েই নিঃশেষ হয়ে যায়। ‘জাতীয় প্রতিরক্ষা’ সংক্রান্ত গতানুগতিক, ক্লিশে ও অচল ধ্যানধারণা গ্রন্থটি বাতিল করে দেয়। বৈরী উপমহাদেশে টিকে থাকতে হলে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার মীমাংসা করতে হবে জনগণকে নিয়ে। দরকার গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। সেই আলোকে হবস, ফুকো, আগামবেন কিম্বা অন্যান্যদের পাঠ করবার দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন লেখক।
পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালপর্বে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব নিতান্তই সোনার পাথরবাটি সেকথা মজহার এই বইতে প্রায় দুই দশক আগে তুলে ধরেছিলেন। একালে রাষ্ট্র পুঁজির স্ফীতি ও পুঞ্জিভবনের হাতিয়ার মাত্র। সার্বভৌমত্ব রক্ষার সস্তা ও অন্তঃসারশূন্য রাজনীতি বুঝতে হলে এই বই অবশ্যই পাঠ্য। সবার আগে চাই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে নিজেদের গঠন এবং বিশ্বব্যবস্থায় সঠিক রাজনীতি ও সমর নীতি। কোন পরজীবী গণবিচ্ছিন্ন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের জনগণকে রক্ষা করতে পারবে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাফল্যের পেছনে ছিল সৈনিক-জনতার মৈত্রী। পঁচাত্তরের সাতই নভেম্বরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা হুমকির মধ্যে পড়লে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে সৈনিক ও জনতার বৈপ্লবিক মৈত্রীই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। এই বৈপ্লবিক মৈত্রীর মুহূর্ত বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। অন্যদিকে এই মৈত্রীর অভাবই বিডিআর গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। অন্যদিকে এই মৈত্রীর অভাবই বিডিআর হত্যাযজ্ঞ ঘটাবার শর্ত তৈরি করে।
রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে নিজেদের প্রতিরক্ষা স্বয়ং জনগণকেই করতে হবে। সৈনিকতার সঙ্গে ‘গণসম্পৃক্তি’র যে কথা জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতি ২০১৮-তে বলা হয়েছে তাকে আরও পূর্ণতা দিতে হবে । নাগরিকতা এবং সৈনিকতার মর্যাদাকে নতুন করে ভাবতে শিখতে হবে। যেন আমরা নিজেরা বুঝি এবং সকলকে বোঝাতে পারি সৈনিক মাত্রই নাগরিক মাত্রই সৈনিক।
গণবিচ্ছিন্ন সেনাবাহিনী দিয়ে বৈরী বিশ্বে আমরা নিজেদের রক্ষা করতে পারব না। চাই গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
গণপ্রতিরক্ষা
ফরহাদ মজহার