মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে, আমারা স্বাধীনতা অর্জন করেছি ২৯ বছর আগে । এই দীর্ঘ সময়ে প্রায় তিন দশকের ব্যবধানে, মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনাবলির আবহ, বিস্তার এবং তাৎপর্য যে কোন মানুষের স্মৃতিতে ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে ওঠার কথা । আর ক্ষেত্রবিশেষে যদি এর ব্যতিক্রমও কিছু ঘটে , তবু তখনকার দুঃখ –যাতনা – সংগ্রামী চৈতন্যের পরিবেশ পরিস্তিতিতে সৃষ্ট মানসিকতার রুপ – রস গন্ধ বজায় রাখা পরিবর্তনের ঢেউ থেকে সেসব আগলে রাখা, তদুপরি অতীতকে যথাস্থানে রেখে বহমান আবেগ এবং উচ্ছ্বাসে এর নির্যাস গ্রহণ করা একেবারেই সহজ বিষয় নয় । অথচ এই অসহজ কাজটি এক বিরল ক্ষমতাবলে সম্পন্ন করেছেন সিদ্দিকুর রহমান । ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানি পাশবিক বাহিনীর বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু হলে তিনি এর বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ জানিয়ে অফিসে হাজির থাকার সরকারি নির্দেশ অগ্রাহ্য করে পরিবারসহ ঢাকা ছেড়ে চলে যান ক্রমান্বয়ে বুহুদূরবর্তী এক গ্রামে । এর ফলে সামরিক আদালত তাকে চাকরিচ্যুত করে । গ্রাম এলাকার যুদ্ধ যখন ভয়ঙ্কর আকারে ছড়িয়ে পড়ে তখন আবার ঢাকায় ফিরে আসেন । কিন্তু মুক্তিবাহিনীর গেরিলা তৎপরতার সাথে তার যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ থাকে । বেতন নেই, আয়ের কোনো পথ নেই, ভাড়া করা বাসা । সম্পূর্ণ অনিশ্চিত জীবন । তদুপরি তাঁর মাথার ওপরে ঝুলতে থাকা সামরিক আদালত থেকে সম্ভাব্য প্রাণদণ্ডাদেশের খড়্গ । সেপ্টেম্বর মাসে তাকে জানানো হয়, ২২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার তাকে সশরীর সামরিক আদালতে হাজির হতে হবে । মুক্তিযুদ্ধ যদি আর সামান্য কিছুকাল স্থায়ী হত তাহলে তার ভয়াল মৃত্যু অবধারিত ছিল । নিশ্চিহ্ন হত তার পুরো পরিবার । এধরনের সার্বক্ষণিক ভীতি , আর্থিক অনটন এবং সহায়হীনতার সাথে যুক্ত হয় পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে তার পিতার করুণ মৃত্যু । স্মৃতিশক্তি বিলুপ্তির তাবৎ উপাদান তাকে ঘিরে প্রবহমান ছিল । মানসিক স্বস্তির তো প্রশ্নই ওঠে না । অথচ মুক্তিযুদ্ধ বইটি পড়লে দেখা যাবে যে পুরো মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনাবলি তিনি নিখুঁতভাবে পাঠকদের চোখের সামনে দৃশ্যমান, সচল করে তুলেছে । এর কোন মানবিক ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নয় । শুধু বলা যায়, এ হচ্ছে তার বিধিদত্ত অলৌকিক সৃতিশক্তির পরিচয়, ব্যাখ্যাতীত মেধার অভিজ্ঞান । এ যাবৎকাল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক যত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে সেসবের কোনোটিই এ গ্রন্থের মতো বাংলাদেশ, যুদ্ধরত বাঙালি জীবন, প্রায়-প্রাত্যহিক ঘটনাসংঘাত, ব্যক্তিক ও সমষ্টিগত ভাবনার ক্রিয়াবৈচিত্রের সামাজিক-ঐতিহাসিক-দার্শনিক ব্যাখ্যাসহ মুক্তিযুদ্ধের স্পিরিট অমন সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে ছড়িয়ে দিতে পারেনি । এক জীবনে এ ধরনের একটি সাহিত্যকর্মই অমরত্বের বলয় নির্মাণের জন্যে যথেষ্ট। এই গ্রন্থে রয়েছে অসংখ্য চরিত্র । রয়েছে A sort of cosmic vision, বিশ্বচরাচরকে মুক্তিযুদ্ধের আবহে প্রত্যক্ষ করার মতো এক অপরুপ স্বপ্নচারিত । এটি শুধু একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়, এর মধ্যে রয়েছে আরো বহু উপাদান, যার ফলে সহজেই মুক্তিযুদ্ধ কে একটি মহাকাব্য অভিধায় চিহ্নিত করা যেতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধ
সিদ্দিকুর রহমান